আতরের সুঘ্রাণ
উৎসর্গ – হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রা. )
শায়লা সিমি নূর
শিথিলতা নিয়ে সূর্যের উদয়, আবছায়া আলোয় কুয়াশার আলখেল্লা পরা সকালে, মাটির উপরিভাগের ধূসরতা যেন সাদা -কালো ফটোগ্রাফ… থেমে থাকা স্থির চিত্র। আবার “জিআইএফ” ইমেজ…. কুয়াশা ঘন হয়ে যাবার দৃশ্য যেন বারবার দেখা যাচ্ছে! ভাতের মাড়ের রং প্রকৃতির ক্যানভাসে… বস্তুত ক্যানভাসে এ রং আনার চেষ্টা করলে ঘন হয়ে অ্যাশ হয়ে যায়, ঠিক এ’ শেড ধাঁধাপূর্ণ… এই রঙের কেমেস্ট্রি… মিস্ট্রি। ভাবতে ভাবতে শরীর ছেড়ে দেয়… একটু থেমে- গুনে নামতে হয় সিঁড়ি…শীত লাগছে ! ঘুম আসলে শীত লাগে কেন? এ নিয়ে ভাবা হয়নি, কারণ ঘুম থেকে উঠে আর এ অবস্থা নিয়ে ভাবা হয়নি… সেই তো ! ঘুম… চোখে লেগে থাকা নেশাগ্রস্থ সকাল যেন!
“মোজাইক করা সিঁড়িসমূহ খুব কঠোর….
পাষান হৃদয়,
মালাকুল মউতের বন্ধু তারা ,
পড়লে আত্মা কাঁচা ছাড়া !”
টিপে-টিপে নামলাম। আস্তে ঢুকে জায়নামাজ পাতি।ওজু করেই ছাদে গিয়েছিলাম (হাত ধোবার সময় বেসিনে কোনো পিঁপড়া ভেসে গেলো কিনা! দৃশ্যটি ভাবতে চেষ্টা করছে মস্তিস্ক।…আগে-পিছে করে কয়েকটি দৃশ্য মনে পড়ে গেলো)… আতর দিলাম, নেশা আরও ঘন হলো… নামাজে দুলতে শুরু করেছি… আতরের গন্ধে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত সময়…
ভিশন:-
সূর্যের আলোকময় মাটির ঘর, মাটি স্পর্শ করে কেন পাথর মনে হলো? আসলে সবই হয়তো একই সূত্রে একটু কঠিন ও একটু নমনীয়! সেটা মাটির রঙে মিশে গাঢ় হয়েছে, একটি শিফনের পর্দার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে একটি কণ্ঠস্বর। অনেক প্রতিশব্দের মধ্যে একটি খুব পরিচিত নাম ধরে ডাকছে অন্য কেউ তাকে… শোনা যাচ্ছে তাকে। গম্বুজের ঘর তবু খুব ফুরফুরে ভিতরের আবহাওয়া।পর্দা সরিয়ে একটি মানুষের উপস্থিতির ভেতর নিজেকে পেলাম, একটি ছেলে শিশু, …কণ্ঠস্বর- “কেমন মানুষ তুমি ? ঐ দিন না বলে চলে গেলে! আর কোনো খবর নেই। তার খবর কিভাবে পাবো ?”
এটি পুরাতন খাট, একটি মাটির ঘড়ায় মনে হলো খাবার পানি, কারণ উপরে একটি গ্লাস রাখা, সব্’ই মাটির রঙে রাঙানো। যেন গোধূলির আকাশ এখানে এসে থেমে আছে… একটি কণ্ঠস্বর – “যাবার সময় অজানা থাকে, তাই বলা যায় না! যার জানা থাকে… তার ভাষায় প্রকাশের অবকাশ থাকে না !” খবর তোমার ভিতরেই আছে, জেনে নাও ইব্রাহিম”
এ দৃশ্যে আমি কণ্ঠস্বর শুনে, সে দিকে আগাবো, যেন আতরের গন্ধে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত সময়, সমুদ্র সমূদয়! মরুভূমির বাতাসের ভার হৃদয়ের জানতে চাওয়া অবস্থার খোরাক জুগিয়ে দিচ্ছে।ভিতরে এক অস্থিরতা যেনো ভীষণ কিছু, ঢের অপেক্ষার পর প্রেমের দর্শন… খুঁজছি… খুঁজতে বেরিয়ে গেলাম।যেতে পথে দেখতে পেলাম একটি জুতোর নকশা…
আলোর খেলায় মেতে থাকা এক সত্তার অন্তর জুড়ানো প্রেম-কাব্য শুনতে পেলাম… উথাল -পাথাল ভালোবাসার কণ্ঠস্বর -”
আমি তোমার জন্য
নিজেকে ভালবাসি
আর আবার… আমার
জন্য তোমাকে
তোমার জন্যই কাঁদি
আর আবার…
আমারই জন্য…
হে! আমার মুহাম্মদ
আবাবিলের তাওয়াফ
আর আগুনের বৃষ্টি
অশ্ববাহিনীর জানা আছে
আর আবার আমারও…
অথচ আজ ভালবাসার বর্ষণে
দুলে উঠা রেঙ্গুন ফুল
আবার বলে দিলো
জন্ম ও মৃত্যু !
তোমার নামে ডাকি,
খুলে যাক সব…
সব বাজার
সদাই করি
প্রেমের বদলে প্রেম
পারান পর্বতে আজ
আলোর খেলা
পৃথিবীর শেষ হয়ে
এলো বেলা!
আজান শুনি
আগুনের উপর
হেটে আসা ঈসার
পায়ে মেঘ…
ওখানে’ই সকল শীতলতা
আবার আমি তাই
তোমার জন্য হাসি
আর আবার…
আমার জন্য…
হে আমার মুহাম্মদ !
ধোঁয়া… ছোট মাটির রান্না ঘরে কাঠের চুলোই কিছু রান্না হচ্ছে, মিষ্টি খাবারের গন্ধ, ভ্যানিলা এসেন্সের মতো কিন্তু, যে সময়ে আমি থেমে আছি তখন কি ভ্যানিলা এসেন্সের ছিল? হুম ! ভ্যানিলা ছিল… কে খাওয়াবে আর কিভাবে কে খাবে তাদেরকেউ কোথাও নেই।শুধু কিছু সাদা আলোর গোধূলি রঙে মিশে যাওয়ার উপস্থিতি আর আতরের সুঘ্রাণ!
ভিশন:-
আমি বাস’এ…অনেক ভিড়, অনেকের সঙ্গেই গা’ লাগালাগি করে বসে আছি।বাসটি একটি আধুনিক মহাসড়কে চলেছে, আমার গন্তব্য ভাবছি… খেয়াল করলাম চালক খুব জোরে চালাচ্ছে, ভিতর… ভিতরে খুব অস্থির হয়ে পড়ছি! সামনের দিকেই বসেছিলাম! অন্য বাহনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। ড্রাইভারের দিকে মুখ করে প্রথমে চোখে চোখ রাখি, ইঞ্জিনের শব্দে না কিছু বলা যায় না শোনা যায়!! “আপনি স্পিড কমান, নাইলে এক্সিডেন্ট হবে!” বাতাস ঝেড়ে বললো,” এই আপনার সমস্যা কি? রাস্তায় গাড়ি চলছে, এতে আস্তে জোরে কি আবার!” গাড়ি থামিয়ে দিলো হঠাৎ ব্রেক করে ! “ভয় করলে নেমে যান- বিরক্ত করবেন না “….হাঁটতে শুরু করলাম।….রাস্তাটা যেন বুক পেতে আছে… মাটির বুক চিরে রুপালি প্রেসমেকার বসানো! বড় সড়কের পাশ গেঁথে একটি সাইড পকেটের মতো জায়গা… ঘেরা দেওয়া… একটু এগোতেই বুঝলাম কবরস্থান। একেবারে পূর্বদিকের শেষ মাথায় যে কবরটা, সে পর্যন্ত গিয়ে মনে হলো, আমি যেন শুয়ে এই ভূমিতে! …পরম স্বস্তিতে! সেখানে সকাল ও সন্ধ্যা অপরূপ সময় নিয়ে উপস্থিত হয়! সূর্যের আলো একই মাত্রায় থাকে… সকল সময় সুখের, “এখানে কেউ শুনিবে না কোনো অসার কথা !” এখানে সব সময় বসন্ত- গ্রীস্ম যেন মিশে একাকার হয়ে আছে! আর সর্বত্র বিকেলের শান্ত আলোর ছটা! একটি নারকেল গাছ দেখে কিছু পাতা নিলাম।পাতার মুকুট আর চেন বানিয়ে সাজিয়ে দিলাম আমার বিছানো বিছানা… আতরের সুঘ্রাণ! গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে অনুভব করছি অনন্তের জাগ্রত নিদ্রাবস্থা…
ভেসে এলো পবিত্র কোরানের একটি বাণী -খুব ধীরে এসে কথাগুলো ভিতরে প্রবেশ করেছে, যেন শুধু কর্ণ নয়, সমস্ত সত্তা দিয়ে শুনতে পাচ্ছি – ” হে মুসা, নিশ্চয় আমি তোমার রব, তোমার পাদুকাদ্বয় খুলে ফেলো, নিশ্চয় তুমি তুয়া নামক পবিত্র উপত্যকায় রয়েছ”
…আতরের সুঘ্রানে মিশে গেছে কিছু শব্দ যা মিষ্টির মতো শুনতে আবার… তাতে কোনো ভারিক্কি নাই! যেন হাওয়াই মিষ্টির ভাষা… অন্য জগৎ থেকে কিছু বলছে! এক শিল্পীর প্রকাশ-শিল্পের মাধুর্যে মিশে আছে আল্লাহর ভালোবাসা ও তার আভিজাত্য এই ক্ষনে!
আপনার মনে আপন বাসা
কোথায় আমার যাওয়া আসা ?
আপনের চেয়ে
আপন’তে অপার
এমন পর…
কেমন পর?
আমাকে চেয়ে…
আপনাকে চাই
আপনাকে পেয়ে…
নিজেকেই পাই
একই আয়নায়…
পাখি তুমি কে ?
আপন সুরে
গেয়ে যান হে !
আমার’ই ছবি আঁকি,
নিজের চোখে…চোখ রাখি,
এ আমি কেমন আমি ?
আপনি বলে নিজেকে ডাকি !
কণ্ঠ শুনে, সে দিকে আগাবো… যেন আতরের গন্ধে ভেসে যাচ্ছে সমস্ত সময়, সমুদ্র সমূদয়!
শায়লা সিমি নূর। সুফী শিল্পী ও কবি। তার কবিতার বই ‘IN THE NAME OF’ গতবছর সার্ক সাউথ এশিয়ান পোয়েট্রি রেকগনিশন করেছে এ-বছর বোডলিয়ান লাইব্রেরি, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-এ সংগ্রহ করা হবে। স্বত্বাধিকারী: বেগম রেস্টুরেন্ট এন্ড গ্যালারি, বেগম প্রকাশনা, বেগম এনিম্যাল কেয়ার, রাজুস রিড লাইব্রেরি।