নিশি রাতের ভয়: রুশিয়া জামান রত্নার গল্প
নিশি রাতের ভয়: রুশিয়া জামান রত্নার গল্প
হারুন সাহেব ছুটির দরখাস্ত হাতে নিয়ে বসের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। বস কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, ভেতরে ভেতরে রাগে তিনি যে ফেটে পড়ছেন তা বুঝতে হারুন সাহেবের একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু তিনি নিরুপায়, ছুটি যে তার লাগবেই!
: হারুন সাহেব, আপনার স্ত্রীকে কি দেখভাল করবার জন্য কি একজন লোকও নেই?
বস বেশ গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন।
: স্যার, জি স্যার৷ আছে স্যার। ওটা তো তার বাবার বাড়ি তাই দেখাশোনা সেবাযত্ন করার লোক নিশ্চয়ই আছে স্যার।
গলা যতটা পারা যায় নরম করে, আন্তরিকতা নিয়ে বললেন হারুন সাহেব।
: স্টুপিড ম্যান!!! তাহলে অফিস রেখে আপনি কেন স্ত্রীর সাথে শশুর বাড়ি এতদিন থাকতে চাইছেন? আমি আমার এতটুকু বয়েসে এমন বউ পাগল মানুষ দেখিনি। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত! এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যান।
বস চিৎকার করে কথাগুলো বললেন। হারুন সাহেব মাথা নিচু করে বসের রুম থেকে বের হয়ে নিজ ডেস্কে ফিরে এলেন। অন্যমনষ্ক হয়ে জানালার ওপাশে আকাশ দেখতে লাগলেন। দিনের ঝকঝকে আলোয় নীল আকাশে ধবধবে সাদা আর ধূসর রং-এর মেঘগুলো উড়ে যাচ্ছে অজানা গন্তব্যে। তিনি এতটাই অন্যমনষ্ক ছিলেন যে অফিসের কলিগরা যে তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে তা বুঝতেই পারলেন না।
আমি কিন্তু হারুন সাহেবকে বেশ পছন্দ করি। তার মত সৎ আর ভালো মানুষ আজকাল খুব বেশি চোখে পড়ে না। দীর্ঘদিন ধরে একসাথে কাজ করছি। কোনদিন তার মুখে কারও নামে মন্দ কথা বলতে শুনিনি। সবসময় পাঞ্জাবি পরেন, মুখ ভর্তি সুন্নতি দাঁড়ি আর মাথায় মানানসই টুপি। নূরানী চেহারা দেখলেই বোঝা যায় এ মানুষ আর যাই হোক খারাপ হতে পারে না। কিন্তু দোষের মধ্যে ঐ একটি স্ত্রীকে ছাড়া একটি রাতও তিনি দূরে থাকেন না। মাঝে মাঝে মনে হয়, ভাবীকে একবার দেখে আসি। কি এমন সৌন্দর্য আছে তার মাঝে যার জন্য হারুন সাহেব বসের এমন নগ্ন বকাঝকা দিব্যি হজম করছেন। অথচ, কাজ নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ তাকে কোন কথা শোনায়নি বরং প্রশংসাই পেয়েছেন। বস তো একদিন সবার সামনেই বলে বসলেন,
: হারুন সাহেব যদি কাজ কর্মে এতটা নিখুঁত আর আন্তরিক না হতেন তবে অনেক আগেই তাকে বিদায় করতাম।
আমি হারুন সাহেবের পাশে গিয়ে বসলাম। আস্তে করে ডাকলাম,
: হারুন সাহেব!
: হু
: কি হয়েছে? ছুটি চাচ্ছেন কেন?
: শওকত সাহেব, কি আর বলবো বলুন? আপনার ভাবী অসুস্থ। ওকে নিয়ে ওর বাবার বাসায় যাব। ওখানে নাকি ওর কোন এক আত্মীয় আছেন। তিনি চিকিৎসা করাবেন। তাই ছুটি চাচ্ছিলাম আর কি!
হারুন সাহেবের বুকের ভিতর থেকে দীর্ঘ একটি শ্বাস বের হলো।
: জানেন তো, আমি আপনাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি। যদি কিছু মনে না করেন তবে একটি কথা বলবেন?
আমি দরদমাখা গলায় বললাম।
: হ্যা, নিশ্চয়ই বলবো। বলুন কি কথা?
কিছুটা উৎসাহী হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন। বুঝলাম আমার সাথে কথা বলতে বলতে তার ভেতরের অস্থিরতা আর গুমোট ভাবটা বেশ কেটে গেছে। মানুষের চরিত্র হয়তো এমনই নতুন ইস্যু পেলে পুরনো ইস্যু ভুলতে খুব বেশি সময় নেয় না।
: আচ্ছা, আপনি ভাবীকে ছাড়া কি একটি রাতও বাইরে থাকতে পারেন না? বিশেষ কোন কারণ আছে কি? সত্যি বলতে, অফিসের আর সবাই আপনাকে নিয়ে যে বাজে বিষয় ইঙ্গিত করে আমার কিন্তু আপনাকে সেরকম মনে হয় না। আমি জানি, বিষয়টা বিব্রতকর তবু আমি জানতে আগ্রহী। প্লিজ আমাকে খুলে বলুন।
বলতে বেশ অসস্তি লাগছিলো। অন্যের একান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা কিংবা আগ্রহ দেখানো আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। কিন্তু আজ হারুন সাহেবের বিষয়টি নিয়ে আমার কৌতূহল দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। আর আজকে বস তাকে যেভাবে রীতিমতো অপমান করলেন তা দেখে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। এক প্রকার বাধ্য হয়ে ছুটে আসলাম।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে হারুন সাহেব আমার চোখে চোখ রেখে বললেন,
: শওকত সাহেব, আপনি কি কখনও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন? এমন কোন মূহুর্তের মুখোমুখি হয়েছেন যখন আপনি বুঝতে পারছেন যে আপনি আর পৃথিবীতে ফিরবেন না। ভয় আর অসহায়ত্বের সর্বোচ্চ অনুভূতি কি কখনও বুঝেছেন?
ধীরে ধীরে শান্ত গলায় তিনি আমাকে বললেন৷ কথাগুলো সূঁচালো বরফের মত আমার কানে বাজছিল। আমি ঐ সময় এমন একটা অনুভূতি অনুভব করলাম যা কোনদিনই করিনি বা করবো বলেও ভাবিনি। অথচ, মৃত্যু তো অনিবার্য। তবুও আমি কত উদাসীন।
: না। এমনটা কখনও অনুভব করিনি।
আমি শুকনো গলায় জবাব দিলাম।
হারুন সাহেব একটু হাসলেন। বললেন,
: চলুন। অফিস ছুটির পর একটু ক্যান্টিনে বসবো।
: আচ্ছা ঠিক আছে। আমার বাসার যাবার খুব বেশি তাড়া নেই।
অফিস ক্যান্টিনে আমি আর হারুন সাহেব চা খেতে বসলাম। তিনি বলতে লাগলেন-
: আমি ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত স্বভাবের। ছাত্র জীবনে একটু আধটু রাজনীতি করতাম। নামায রোজা করার মত মানুষ আমি কস্মিনকালেও ছিলাম না। একটি মেয়েকে পছন্দ করতাম। অন্য জায়গায় তার বিয়ে হয়ে যাবার পর প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছিলাম। বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিলেন এক মেয়ের সাথে। বিয়ের আগে মেয়েটির সাথে দেখা তো দূরে থাক একটি কথাও বলিনি। মেয়েটও আগ্রহ দেখায়নি৷ শুনেছিলাম মেয়েটি বেশ পরহেজগার৷ আসলেই তাই। ওর মত পরহেজগার আর বুদ্ধিমতী মেয়ে আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। নিজের স্ত্রী বলে বলছি না, আসলেই হুমায়রা একেবারে অন্যরকম৷ ওর মতো মেয়ে আজকাল খুবই কম দেখা যায়।
: ওহ!! ভাবির নাম বুঝি হুমায়রা? বাহ! নামটি তো বেশ সুন্দর। আমার ভাগ্নির নামও হুমায়রা।
হারুন সাহেবের কথার মাঝেই বলে ফেললাম।
হারুন সাহেব একটু মুচকি হাসলেন। বললেন,
: আচ্ছা তাই না কি?
এরপর তিনি চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ নীরবে থেকে নিচু গলায় কিছুটা অনুতপ্ত স্বরে বললেন,
: জানেন, শওকত সাহেব! অথচ এমন ভালো একটি মেয়েকে আমি তিল তিল করে কষ্ট দিয়েছি। এমনকি বিয়ের পর থেকে ওর সাথে আমি থাকতাম না। ও নীচে ঘুমাতো। আমার মনে হতো ওর সাথে আমার ঠিক যায় না! ওর মনমানসিকতা আমার থেকে আলাদা।
একদিন কি নিয়ে যেন মেজাজটা খুব চড়ে ছিল। বাসায় ফিরে এসে দেখি ও ঘুমাচ্ছে। ও সময় ওর শরীর অসুস্থ ছিলো । আমি অবশ্য এটা জানতাম না। জানার কথাও না। নিজেকে সামলাতে পারলাম না জোরে ওর মুখে এক লাথি বসিয়ে দিলাম।
: কি বলছেন এসব?
আমি চমকে উঠলাম। এতটা নিষ্ঠুরতা মোটেই প্রত্যাশা করিনি।
: হুম। আমি জানি আমি কতটা জঘন্য কাজ করেছি।
হারুন সাহেবের বুক চিড়ে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস নেমে আসলো।
:তারপর?
আমার প্রশ্ন
: ও জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। বহু কষ্টে জ্ঞান ফেরালাম। ভয়ে ছিলাম যদি কাউকে বলে দেয়! কিন্তু না, হুমায়রা কাউকে কিছুই বললো না। মাকে বললো ও একটু বাবার বাসায় যেতে চায়। কিছুদিন থেকেই আবার চলে আসবে। মা সম্মতি দিলেন আর আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ঐদিনই আমার শ্বশুর মশাই ওকে নিয়ে গেলো। বাবা আবার মাকে নিয়ে গেলেন খালার বাসায়। পুরো বাড়িতে আমি একা রইলাম। গভীর রাত অব্দি জেগে জেগে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। সারা ফ্ল্যাট জুড়ে অন্ধকার। অন্যান্য ফ্ল্যাটের মৃদু আলোতে ঘর ঝাপসা দৃশ্যমান থাকলেও ওমন স্তব্ধ পরিবেশ বেশ উপভোগ করছিলাম। এক সময় একটু তন্দ্রার মতো লাগলো। মনে হয় ঝিমুচ্ছিলাম একটা অদ্ভুত শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। কুকুরের গড়গড় শব্দের মতো। আমি এক পাশ হয়ে শুয়ে ছিলাম। শব্দটা শোনার পর মাথা তুলে দেখতে চেষ্টা করলাম ওটা কিসের শব্দ। দেখি, হুমায়রা যেখানটায় ঘুমাতো তার পাশে বিশাল সাইজের একটা কুকুর বসে আছে। কুকুরের চোখ দুটু আগুনের শিখার মত লাল। মনে হচ্ছিল ওর ভিতর জাহান্নামের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে, সারা শরীরে কালো লোম সজারুর কাঁটার মত খাড়া, দুটু দাঁত হাতির দাঁতের মত বাইরে বেরিয়ে এসছে। মুখটা সাদা। ওটা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। কুকুরটাকে দেখার পর আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল, সামান্য নড়াচড়া করার শক্তিটুকু নেই। সম্মোহিত হয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে আছি। জানি না কতক্ষণ এভাবে ওটার দিকে চেয়ে রইলাম। না, চেয়ে রইলাম না, চেয়ে থাকতে বাধ্য ছিলাম। হঠাৎ ভেল্কিবাজির মত কুকুরটা নিমেষে একজন মানুষের অবয়ব নিল। আমি যে চিৎকার করবো সে শক্তিটুকুও নেই। রাত ক’টা বাজে তাও জানি না। দেখলাম, একজন কুঁজো বুড়ো লোক বসে আছে কুকুরটা যেখানে বসে ছিল ঠিক সে জায়গাতে। সারা গায়ে বড় বড় লোম। মাথা ভর্তি জটলা চুল। আমি ভয়ে জমে গিয়েছি প্রায়। অবয়বটা আমাকে অবাক করে দিয়ে কুকুরের মত এক লাফ দিয়ে খাটে উঠে পড়লো। আমার পিঠে বসে ঘাড় চেপে ধরে সে কি উল্লাস তার৷ ঘড়ঘড় আওয়াজ করে যাচ্ছিল আর কি যেন বলছিল। সে ভাষা বোঝার সাধ্য আমার ছিল না। আমার মনে হচ্ছি ভয় আর আতঙ্কে আমি মারা যাবো। ওটার শরীর যেন একটি পানির পলিথিন। কোন শক্ত বস্তু নেই। যতই চেষ্টা করি ওটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে ততই ওটা চেপে বসে। মনে মনে যত দোয়া কালাম পারি সব পড়তে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন কিছু মনে পড়লো না। ঐ সময় হুমায়রার কথা মনে পড়লো। বিশ্বাস করুন, সত্যি বলছি। ঐ সময় আর কারও কথাই মনে হয়নি। মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ এবারের মত মাফ করুন। যদি বেঁচে যাই তবে আমার পাপের জীবন আর নয়।
নানা অনুশোচনা আমাকে গ্রাস করে ফেললো। চোখের পানি আর মুখের লালায় বালিশ ভিজে চপচপ করছে৷ একসময় ফজরের ওয়াক্ত শুরু হলো। ওটা যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই লাফ দিয়ে নেমে গেল। আমি এক ঝটকায় উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। কি ভয়ানক অভিজ্ঞতা!!! যে কখনও ও রকম পরিস্থিতিতে পড়েনি সে কখনও বুঝবে না, উপলব্ধিও করতে পারবে না। ফজরের আযান হলো। গোসল করে নামায পড়লাম। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলাম। পরে হুমায়রার কাছেও ক্ষমা চেয়ে নিলাম। ওর হাত ধরে কান্না করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, যতদিন বেঁচে থাকবো তোমাকে ছাড়া একটি রাতও দূরে থাকবো না।
হারুন সাহেবের বলা শেষ হলো। তার চোখ চকচক করছিল। এমন একটি ঘটনা কাউকে বলতে পেরে তিনি বেশ প্রফুল্ল হলেন। আমি তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। বললাম,
: হারুন সাহেব, দোয়া করবেন এমন পরিস্থিতি আমার যেন না হয়। এর আগেই যেন আমি হেদায়েতের পথে আসি।